পৃথক শিশু আদালত না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে বিচার

নিউজ ডেস্ক : কাঠগড়াবিহীন লালসালু ঘেরা কক্ষে শিশু অপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠানের ওপর শিশু আইনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না ঢাকা মহানগরীর একমাত্র শিশু আদালতে।

অন্যদিকে কোনো শিশু অপরাধীর বিচার চলাকালীন আদালত কক্ষে উপস্থিত আইনজীবী ও পুলিশ সদস্যদের ইউনিফরম পরিধানের ওপর একই আইনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেটাও পরিপূর্ণভাবে মানা হচ্ছে না।

এদিকে শিশু অপরাধীদের মামলা প্রতিদিন বাড়লেও এখনো পৃথক আদালত কক্ষ তৈরি না হওয়ায় সার্বিকভাবে শিশু আইন ২০১৩-এর উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

শিশু আইন ২০১৩ প্রণীত হওয়ার পর সরকার ২০১৪ সালে মহানগর এলাকায় এবং প্রতি জেলায় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিশু আদালত গঠন করেন। এরপর পর থেকেই শিশু অপরাধীদের মামলা ঢাকাসহ সারা দেশের শিশু আদালতে বিচার কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীর জন্য ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতকে শিশু আদালত ঘোষণা করা হয়।

২০১৪ সাল থেকে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ একই সঙ্গে শিশু আদালত হিসেবেও কার্যক্রম শুরু করে। তবে ২০১৫ সালের ৪ অক্টোবর থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে শিশু মামলা আলাদা রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ শুরু হয়। রেজিস্ট্রার অনুযায়ী ওই দিন থেকে গত ২২ মে পর্যন্ত ওই আদালতে প্রায় সাড়ে ৬০০ মামলা বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছে। এসব মামলায় প্রায় ১ হাজার শিশু আসামি। মামলাগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক হত্যা মামলা। বাকিগুলো মাদক, চুরি, ডাকাতি, নাশকতা ও ধর্ষণের মামলা।

বাৎসরিক হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ওই আদালতে মামলা হয় ২০০টি, ২০১৬ সালে ২৯১টি এবং চলতি বছর ২২ মে পর্যন্ত ১৬৫টি।

আদালত সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে ১৩ মামলায় ১৫ জনকে খালাস দিয়েছেন আদালত। আর ১৩ মামলায় ১৫ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে ১১ মামলায় ২৫ জনকে খালাস এবং আট মামলায় ১০ জনকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। ওই সালে নারী নির্যাতন আইনের মামলায় দুইজনকে সাজা দিয়েছেন আদালত।

এদিকে মামলার সংখ্যা বাড়লেও শিশু অপরাধীদের মামলা বিচারের জন্য পৃথক কোনো শিশু আদালত গঠন হয়নি। প্রতিদিনই কার্যতালিকায় প্রায় ১২-১৫ শিশুর বিরুদ্ধে ট্রায়াল মামলা এবং তদন্তাধীন মামলা থাকে। যা শুধু শিশু আদালতের জন্য নিয়োগ দেওয়া একজন বিচারকই পর্যাপ্ত সময় দিয়ে নিশ্চিত করতে পারেন।

এদিকে শিশু আইন ২০১৩ এর ১৭ ধারার ৪ উপধারা বলা হয়েছে যে, ‘সাধারণত যে সব দালান বা কামরায় এবং যে সব দিবস ও সময়ে প্রচলিত আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় তা ব্যতীত, যতদূর সম্ভব, অন্য কোনো দালান বা কামরায়, প্রচলিত আদালতের ন্যায় কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা আদালত কক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ কক্ষে এবং অন্য কোনো দিবস ও সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ব্যতীত শুধু শিশুর ক্ষেত্রে শিশু-আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠান করিতে হইবে।’

কিন্তু ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজের লালসালু ঘেরা আদালত কক্ষেই শিশু অপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

অন্যদিকে শিশু আইন ২০১৩ এর ১৯ ধারার ৪ উপধারা বলা হয়েছে যে, ‘অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু-আদালত কর্তৃক শিশুর বিচার চলাকালীন, আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারী আদালত কক্ষে তাহাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফরম পরিধান করিতে পারিবেন না।’

কিন্তু বিচারকালে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা তাদের ইউনিফরম পরিধান করেই আদালত কক্ষে থাকেন। এ ছাড়া আইনজীবীরা ইউনিফরম গাউন পরিধান না করলেও কালো কোর্ট পরিধান করেই শুনানিতে অংশ নেন।

এ সম্পর্কে ওই আদালতের সহকারী সরকারি কৌঁসুলি সাহাবুদ্দিন মিয়া বলেন, ‘আসলে কক্ষ না থাকায় প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত কক্ষেই আপাতত শিশুদের বিচার করতে আমরা বাধ্য হচ্ছি। তবে পুলিশ ভাইয়েরা এবং আমাদের আইনজীবী সদস্যরা অনেক সময় ইউনিফর্ম পরেই শুনানিতে চলে আসেন। এ বিষয়টি আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে লক্ষ্য রাখা উচিত। তবে ইদানিং এর ব্যবহার অনেকাংশে কমে এসেছে। আশা করছি শিশু আদালতের বিচারকাজ চলাকালে অচিরেই সকলে ইউনিফর্ম ব্যবহার পরিহার করবেন।’

এদিকে নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কিশোর আদালতে মামলা পরিচালনার যে পরিবেশ দরকার তা হয়ে ওঠেনি। জানতে পেরেছি এই আদালতের জন্য অর্থায়ন করা হয়েছে, যা জুন-জুলাই এর মধ্যে কার্যকর হতে পারে।

আদালতের অবকাঠামো ঠিক হলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন এ কর্মকর্তা।

এ সম্পর্কে শিশুদের কল্যাণের জন্য শিশু আদালতে দায়িত্বে থাকা এনজিও অপরাজেয় বাংলার প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা রাহেনা চৌধুরী বলেন, শিশুদের বিচারিক কক্ষ এমন হবে, যা দেখে যেন বোঝা না যায় যে এটি একটি বিচার কক্ষ। যেখানে সব কিছু থাকবে শিশুদের অনুকূলে। সবেমাত্র আমরা শিশু আদালতের কার্যক্রম শুরু করেছি। আস্তে আস্তে হয়তো সব হবে।