নিউজ ডেস্ক : মাগরিবের আজান হলো। তার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বাঁশিতে ঘন ঘন ফুঁ। বাঁশির এই শব্দ তো লোক তাড়ানো সংকেত। হ্যাঁ, ঠিক তাই। লোকই তাড়ানো হচ্ছে। ঘন ঘন বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সবাইকে সীমানার বাইরে বের করার চেষ্টা। চেষ্টাও সফল। কোনো বেগ পেতে হয়নি। দুই মিনিটেই ফাঁকা। বন্ধ করে দেওয়া হলো দুই পাশের গেট।
বাইরে থেকে দেখা গেল ভেতরে শুধু অন্ধকার। তবে গোধূলির আলোয় পাতাহীন গাছের ডালপালা দেখা যাচ্ছে শুধু। ডান দিকে গেটের পাশের অফিস ঘরটিতে জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি। সীমানার ভতরে আর কোথাও কোনো আলো নেই।
কিছুক্ষণ আগে যেখানে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ, যেখানে ছিল শিশু-কিশোর-বৃদ্ধের কোলাহল। সেখানেই নেমে এল নীরবতা, নিস্তব্ধতা। কারণ যারা এসেছিলেন তারা এখানে কেউই থাকতে আসেননি। এসেছিলেন ক্ষণিকের জন্য। তাদের বাড়ি আছে, ঘর আছে, গন্তব্য আছে, পরিবার আছে, রাতে তারা সেখানেই যাবেন।
এখানে অন্ধকারে তারাই আছেন, যারা সেই একাত্তর থেকেই রয়েছেন। সবাই আসবে, চলে যাবে। কিন্তু তারা কখনো যাবেন না। মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজারের এই বধ্যভূমিই তাদের চিরকালের বাসস্থান। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা যাদের নির্মমভাবে হত্যা করে রাতের অন্ধকারে এখানে ফেলে গেছে, বাংলার গর্বিত সেই সন্তানেরা আছেন এই বধ্যভূমিতে ।
শুক্রবার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, বধ্যভূমির সামনে অনেকে পসরা সাজিয়ে বসেছেন। কেউ কেউ বসেছেন ফুসকা-চটপটির দোকান নিয়ে। বসে খাওয়ার জন্য দোকানগুলো ঘিরে চেয়ার টেবিল বসানো। কেউ বাদাম, চানাচুর, ঝালমুড়ি নিয়েও বসেছে। রয়েছে শিশুদের নানা রকম খেলনা। ভাসমান পতাকা বিক্রেতাও রয়েছেন কয়েকজন।
বাঁ পাশের গেট দিয়ে ভেতরে গিয়ে বড় একটি গাছ। গাছের নিচে ফাঁকা জায়গাটা খাঁ খাঁ করছে। যেন একটা অপূর্ণতা। এখানেই কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল কাদেরের (৬৩) সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাবা শাহেদ আলী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১২ বছর হলো তিনি মারা গেছেন। বধ্যভূমির পাশে বাসা হওয়ায় প্রতিদিনই তিনি এখানে আসেন।
আব্দুল কাদের বলেন, একাত্তর সালে তিনি এই বধ্যভূমিতে অনেক মৃতদেহ দেখেছেন। বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ হওয়ার আগে এখানে ইটের ভাটা ছিল। এখানে রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা কখন বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ ফেলে গেছে, তা দেখেননি। সকালে দেখেছেন কারো গলা কাটা, কারো হাত নেই, কারো পা কাটা, কারো বুকে-পিঠ গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত সেই মৃতদেহগুলো আজও চোখে ভাসে। নুরজাহান সড়কে একটি পরিবারের সবাইকে রাজাকাররা যে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, সেই দৃশ্য আজও তিনি ভুলতে পারেননি।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. শাহেদ জানান, প্রতিদিনই এখানে লোকসমাগম হয়। তবে শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় লোক বেশি আসে। বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধটি নির্মিত না হলে হয়তো এত লোক এখানে আসত না। স্মৃতিসৌধটি হওয়ায় আজও যেন তারা বেঁচে আছেন। যাদের টানে অনেকেই এখানে আসেন।
কেউ কেউ আসেন অবসরে সময় কাটাতে, কেউ আসেন স্বজনদের নিয়ে। ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন খেলতেও আসেন অনেকে। আবার গোল হয়ে বসে অনেকে গল্প করছেন। কেউ ছবি তুলছেন। কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কোথাও বেঞ্চে বসে আছেন তরুণ-তরুণী। টাকার বিনিময়ে প্রেশার ও ওজন মাপার ব্যবস্থাও আছে।
কথা হয় রোকেয়া বেগম ও তার মেয়ে সাথী হাসানের সাথে। সাথী বলেন, তারা প্রায়ই এখানে আসেন। পরিবেশটা খুব ভালো। অনেক লোকসমাগম হয়, যা তাদের ভালো লাগে। অবসর পেলেই বাসায় বসে না থেকে এই বধ্যভূমিতে এসে বসে থাকেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে থাকেন। মাগরিবের আজানের পরপরই বাসায় চলে যান।
এখন বিজয়ের মাস, তাই পতাকা বিক্রি করছেন কেউ কেউ। বাঁশের কঞ্চি বা অন্য কোনো কাঠির সঙ্গে বিভিন্ন সাইজের পতাকা বেঁধে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছেন মো. মিঠুন। তিনি জানান, তিনি মৌসুমি পতাকা ব্যবসায়ী। বিজয়ের মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু করে ১৬ দিন পতাকা বিক্রি করেন।
তার কাছে ১০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকা দামের বিভিন্ন সাইজের পতাকা আছে। কয়েকজন অভিভাবককে মিঠুনের কাছ থেকে তাদের শিশুদের জন্য পতাকা কিনতে দেখা যায়। ক্রেতারা জানান, শিশুদের মধ্যে জাতীয়তা বোধে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে লাল-সবুজের পতাকা কিনে দিচ্ছেন। মিঠুন বলেন, আজ প্রথম বিক্রি করতে এসেছি। প্রথম দিন হিসেবে বেশ ভালোই বিক্রি হয়েছে।
মাগরিবের আজানের পর যিনি বাঁশি দিয়ে লোক বের করে দিচ্ছিলেন কথা হয় তার সঙ্গে। বধ্যভূমিতে সন্ধ্যার পর কোনো বাতি জ্বালানো হয় কি না, জানতে চাইলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ১২টি বাল্ব ছিল। তার মধ্যে ১০টি নষ্ট। বিজয়ের মাস এসেছে। তাই আবার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। শুনতেছি নাকি ঠিক করবে। সারা বছর কোনো খোঁজই থাকে না। আর দু-এক দিনের জন্য কত আয়োজন। তবে তিনি নিজের পরিচয় দিতে রাজি হননি। বলেন, এখানকার লোক এখন না থাকায় তিনি বাঁশি দিয়ে লোক বের করার দায়িত্ব পালন করেছেন।
এরপর খুঁজে পাওয়া যায় ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা মো. শামীমকে। তিনি বলেন, বাল্বের বেশির ভাগই নষ্ট। এ ছাড়া বিজয়ের মাস আসায় মেরামতে ও সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে।
ভেতরে ঢুকে দেখা যায় স্মৃতিসৌধের ভেতরের জলাধারে রয়েছে ময়লা আবর্জনা। ছেঁড়া স্যান্ডেল। পানি নোংরা। ডান পাশের গেটে গণপূর্ত অধিদপ্তরের লাগানো সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে,‘আগামী ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপন উপলক্ষে মেরামত ও সংস্কারের কাজ চলিতেছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।’
প্রতিদিনই চলে একই নিয়ম! সন্ধ্যা নামে। বাঁশিতে ফুঁ দেন গার্ডরা। বেরিয়ে যেতে থাকে সবাই। এরপর সেখানে নেমে আসে গভীর নিস্তব্ধতা। রাত গভীর হয়। অন্ধকারে শুধু থাকেন তারা। নিস্তব্ধতায় হয়তো বুদ্ধিজীবীরা অপেক্ষায় থাকেন আবার কখন রাত ফুরিয়ে বিকেল হবে!
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকাররা। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক ও অন্যান্য পেশাজীবী। যাদের মৃতদেহ এনে ফেলা হয় এই রায়েরবাজার ইটখোলায়।
সেখানেই নির্মিত হয়েছে এই বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ। ১৯৯৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।