নিউজ ডেস্ক : ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে যখন বলছিলেন, ‘…অনেক সহ্য করেছি। এখন শত্রুর প্রতি চরম ধ্বংসাত্মক প্রত্যাঘাত হানার সময় এসেছে। আমাদের সেনাবাহিনী শত্রুকে আমাদের ভূখণ্ড থেকেই বিতাড়িত করবে না, শত্রুর ভূখণ্ডে গিয়ে তাদের নির্মূল করবে’ তখন বহুদূর দেশ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরেও চলছিল আরেকটি যুদ্ধ। এ যুদ্ধ বাংলাদেশ প্রশ্নে তর্ক-বিতর্কের। অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণার পর কূটনীতির লড়াইয়েও আসে চরম মুহূর্ত। বাংলার ভাগ্য নিয়ে জাতিসংঘে সেই যুদ্ধ চলে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
সত্য এই যে, বাংলাদেশে গণহত্যা ঠেকাতে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ প্রথম কামনা করে ভারত। সে সময় পাকিস্তান তাদের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের তুমুল বিরোধীতা করে। কিন্তু পাশার দান উল্টে যেতে থাকে জুলাই মাসের দিকে। এ সময় পাকিস্তান নিজেই বাধ্য হয় জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে। ততদিনে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের অবস্থান স্পষ্টতই বদলে গেছে। তাদের বক্তব্য তখন ভিন্ন । পূর্ব পাকিস্তানের গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত সমস্যার সমাধান হবে না, এই যুক্তিতে ভারত তখন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকের বিরোধিতা করতে থাকে।
৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদে প্রথম বৈঠক বসে। সেদিনই ঢাকার আকাশে শুরু হয় বিমান যুদ্ধ। আকাশে বিমানের ডগফাইট ঢাকার নাগরিকরা দিনের আলোয় নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে বাড়ির ছাদে উঠে অবলোকন করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকাবাসীর মধ্যে তখন প্রচণ্ড বিস্ময় এবং উত্তেজনা। অনেককে এ সময় মিত্র বাহিনীর পাইলটদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাতেও দেখা যায়। অন্যদিকে উত্তেজনা বাড়ছিল জাতিসংঘেও। এদিন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন বক্তব্য দেন। তিনি বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী’ উল্লেখ করে বলেন, ‘… বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, শুধু এ জন্য নয় যে ভারত সহায়তা দিচ্ছে। ভারত দেশটিকে সহায়তা অব্যাহত রাখবে এ কারণে যে সাত কোটি মানুষের মানবিক চেতনা ধ্বংস করা যায় না। … অস্ত্রবিরতি নিয়ে বহু কথা বলা হলো। এ-সংক্রান্ত এমন কিছু দলিলপত্রে আমি চোখ বুলিয়েছি। কার কার মধ্যে অস্ত্রবিরতি? এই তথাকথিত অস্ত্রবিরতির মাধ্যমে আমরা কী পাকিস্তানি সৈন্যদের ছেড়ে দেব যেন তারা তুলকালাম চালাতে পারে; ঢাকায়, চট্টগ্রামে আর অন্য সব জায়গায় বেসামরিক মানুষকে হত্যা করতে পারে? এ রকম অস্ত্রবিরতিই কী আমরা কামনা করছি? সৈন্যরা যে দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েছে, তা থেকে তাদের মুক্ত করে দিতে হবে যাতে তারা নারীদের হত্যা করতে পারে আর ধর্ষণ করতে পারে ১৯, ১৭, ১৫, ১৩, ১১ অথবা তারও কমবয়সী মেয়েদের?
সমর সেনের এই প্রশ্নের উত্তর সেদিন নিরাপত্তা পরিষদের কেউ দিতে পারেনি। যদিও ভেতরে ভেতরে চলছিল পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের পরিকল্পনা। ৫ ডিসেম্বর সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবিলম্বে পাক-ভারত যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা চালানোর জন্য নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করে। নিরাপত্তা পরিষদের ১১ সদস্য মার্কিন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। এর বিপক্ষে তখন একমাত্র কণ্ঠস্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাকে সমর্থন দেয় পোল্যান্ড। এই দুই দেশ তোলে পাল্টা দাবি- সবার আগে প্রয়োজন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান। বলাবাহুল্য নিরাপত্তা পরিষদে সেদিন এর সমাধান মেলেনি।
সেদিন জাতিসংঘে সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিক ভাষণ দেন। তার বক্তব্যের অংশ বিশেষে পরিষ্কার হবে শত্রুপক্ষ কী চাইছিল এবং কীভাবে তারা দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতে দেননি। শুধু তাই নয়, ‘বিদ্রাহী’ হিসেবে নয় বিশ্ব দরবারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম হিসেবে পরিচিত করতেও তার সেদিনের বক্তব্য ভূমিকা রেখেছে। ইয়াকভ মালিক বলেন, ‘… এখানে এক বক্তৃতায় ‘বিদ্রোহী বাহিনী’ অভিধা ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এর অস্তিত্ব কে নির্ণয় করেছে? এ বিষয়ে সঠিক ধারণা পেতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের ভাষ্য শোনা নিরাপত্তা পরিষদের জন্য ভালো হবে। … আওয়ামী লীগ সংসদীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এ কথাটা সারা দুনিয়া জানে। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমেও খবরটি প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু এই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলটির বিরুদ্ধে সামরিক কর্তৃপক্ষের কিছু পদক্ষেপের ফলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব। … আমরা যাদ ‘উটপাখির নীতি’ অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেই আর বালুতে মাথা গুঁজে রাখি তাহলে এটা নিয়ে ভাবনা এড়িয়ে যেতে পারি। কিন্তু এই পরিস্থিতির আরও একটা প্রত্যয় আছে, যা জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনগুলোর কাজকর্মে আকছার উঠে আসে। তার নাম জাতীয় মুক্তিবাহিনী ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম।