অন্ধকারে পৃথিবীর আকাশ যদি ভরে যায় সবুজ রঙে তাহলে কি সেটা কি আশ্চর্যজনক কিছু নয়?

নিউজ ডেক্স: রাতের বেলায় পৃথিবীর আকাশ কালো হয়ে যাবে এবং সেখানে ফুটফুটে নক্ষত্র জ্বলতে দেখা যাবে আমাদের দেশের মানুষের কাছে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু রাতের অন্ধকারে পৃথিবীর আকাশ যদি ভরে যায় সবুজ রঙে তাহলে কি সেটা কি আশ্চর্যজনক কিছু নয়?

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে রাতের বেলা এমন আকাশের দেখে মেলে পৃথিবীর কিছু দেশে। মূলত উঁচু অক্ষাংশের দেশগুলোতে প্রায়ই রাতের বেলা আকাশের কিছু অংশে সবুজ রঙ ছড়িয়ে থাকে। তবে মাঝে মাঝে নীল, লাল, বেগুনী রঙের দেখাও মেলে। আকাশের রঙের এই ঘটনাকে বলা হয় ‘আরোরা’, বাংলায় মেরুজ্যোতি। আমাদের কাছে আশ্চর্যজনক মনে হলেও পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের মানুষের কাছে সাধারণ একটি প্রাকৃতিক ঘটনা।

‘আরোরা’ শব্দটি মূলত লাতিন থেকে আগত। লাতিন শব্দে এর অর্থ হল ভোর, যা রোমান পুরাণ এবং লাতিন কবিতায় ভোরের দেবী হিসেবে পরিচিত। এছাড়া গ্রিক পুরাণে ‘এয়স’, হিন্দু পুরাণে ‘ঊষা’ এবং ইন্দো-ইউরোপীয় ভোরের দেবী হিসেবে আরোরা বেশ পরিচিত।

পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র, সূর্য এবং পৃথিবীর বাতাস ‘আরোরা’ সৃষ্টির জন্য মূলত দায়ী। আমরা জানি যে সূর্য থেকে প্রতিনিয়ত প্রচুর চার্জিত কণা মুক্ত হয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। সূর্য থেকে আমাদের দূরত্ব অনেক হলেও আমরা এই মুক্ত চার্জিত কণা বা প্লাজমার প্রভাব থেকে বাইরে নই।

সূর্য থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া এইসব কণা যখন পৃথিবীতে পৌঁছায় তখন এসব কণা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র এবং বায়ুমন্ডল এর সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে। আমাদের পৃথিবীর উপরিভাগে বিভিন্ন স্তর রয়েছে। যেখানে বাতাস সহ আরো অনেক কিছু বিদ্যমান। পৃথিবীর বাইরে থেকে পৃথিবীর ভূমিতে কিছু আসতে গেলে এইসব স্তর অতিক্রম করেই তারপর আসতে হবে। যখন সূর্য থেকে চার্জিত মুক্ত কণাগুলো আমাদের পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে এবং পৃথিবীকে অতিক্রম করে যেতে চায় তখন পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র এসব কণাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। আমরা জানি যে পৃথিবী একটি তড়িৎ পরিবাহক। এবং এটি কোনো মুক্ত চার্জিত কণাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। ধনাত্মকভাবে আহিত বস্তুকে ভূ-সংযুক্ত করলে পৃথিবী থেকে ইলেকট্রন এসে বস্তুকে নিস্তড়িত করে। আর ঋণাত্মকভাবে আহিত বস্তুকে পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত করলে বস্তু থেকে ইলেকট্রন ভূমিতে প্রবাহিত হয়, ফলে বস্তুটি নিস্তড়িত হয়।

এই কারণে সূর্য থেকে মুক্ত এই চার্জিত কণাগুলো পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে পৃথিবীর মাটিতে চলে আসতে চায়। এই আসতে চাওয়ার মাঝে এই চার্জিত কণাগুলোকে ওজনস্তর সহ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল অতিক্রম করতে হয়। এবং এই অতিক্রম করার সময় সূর্য থেকে আগত চার্জযুক্ত এই মুক্ত কণাগুলো বায়ুমন্ডলের অণু-পরমাণুকে আঘাত করে যার ফলে বায়ুমন্ডলের অণু-পরমাণুগুলোকে আন্দোলিত হয়। যেহেতু পরমাণু নিউক্লিয়াস এবং নিউক্লিয়াসকে আবর্তনকৃত ইলেক্ট্রন দ্বারা গঠিত তাই যখন সূর্য থেকে আগত চার্জিত কণা বায়ুমন্ডলের পরমাণুকে আঘাত করে তখন ইলেক্ট্রনগুলো উচ্চ শক্তিস্তরে ঘুরতে ঘুরতে থাকে এবং এক সময় নিম্ন স্তরে গমন করে।

যখন কোনো পরমাণুর ইলেক্ট্রন উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তরে গমন করে তখন সেখানে ফোটন বা আলোকশক্তিতে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আকাশে যখন আলো উৎপন্ন হয় তখন তাকে আরোরা বা মেরুজ্যোতি বলে অভিহিত করা হয়। প্রাচীনকালে এইসব আলো নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার প্রচলিত ছিল, যে কারণে প্রাচীন মিথে ‘আরোরা’র বর্ণনা পাওয়া যায়।

তবে পৃথিবীর সবখানে আরোরার দেখা মেলে না। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র দুই মেরু বরাবর সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল থাকায় সূর্যের এইসব মুক্ত চার্জিত কণা মূলত পৃথিবীর মেরু অঞ্চল বরাবর পরিভ্রমণ করে। যে কারণে শুধুমাত্র মেরু অঞ্চলেই আরোরা বেশি দৃশ্যমান হয়। উত্তর অক্ষাংশের আরোরা সুমেরুপ্রভা, আরোরা বুরেলিস, দ্য নর্দান লাইট নামে পরিচিতও। আর দক্ষিণ অক্ষাংশে একে বলা হয় কুমেরুপ্রভা, আরোরা অস্ট্রালিস বা দ্য সাউদারন লাইট।

আরোরার বিভিন্ন রঙ থাকলেও অধিকাংশ সময় আরোরার রঙ হলুদাভ সবুজ দেখা যায়। এই রঙের জন্য অক্সিজেন বিশেষভাবে দায়ী। অক্সিজেন থেকে অনেকক্ষেত্রে লাল রঙ এর আরোরাও তৈরি হয়। নাইট্রোজেন সাধারণত একটি নীল রঙের আলো দেয়। এছাড়াও অক্সিজেন এবং নাইট্রজেন একসঙ্গে আলো উৎপন্ন করলে বেগুনী রঙ দেখা যায়। তবে বেগুনী রঙ খুব কমই দেখা যায়। মাঝে মাঝে এতে গোলাপী রঙও দেখা যায়।

আরোরাগুলো মাঝে মাঝে আলোর পর্দার মতো দেখায়। তবে এরা গোলাকার অথবা সর্পিল বা বাঁকানোও হতে পারে। সূর্য থেকে যে চার্জিত কণার ফলে আরোরার আবির্ভাব হয় সেই চার্জিত কণার প্রভাবে অনেক সময় কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ ও ইলেক্ট্রিক্যাল পাওয়ার গ্রিডে সমস্যা দেখা দেয়।

সাধারণত উঁচু অক্ষাংশের দেশগুলোতে সন্ধ্যা এবং রাতের বেলায় আরোরা দেখা যায়। এর মধ্যে কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আইল্যান্ড, গ্রীনল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি আরোরা দেখা যায়। এছাড়া কানাডিয়ান সীমান্তের কাছাকাছি যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরসীমায় সাধারণত বছরে কয়েক বার আরোরা দেখা যায়। প্রতি দশকে একবার ফ্লোরিডাতে কিংবা জাপানেও আরোরা দৃশ্যময়ান হয়। তবে আরোরা দর্শনের সবচেয়ে ভালো স্থান হলো আলাস্কা, কানাডা, এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কিছু অঞ্চল। এসব স্থানে প্রায় নিয়মিতই মেরুজ্যোতি চোখে পড়ে। তাই রাতের বেলা রঙিন আকাশের নিচে রাত কাটাতে চাইলে এসব স্থানের থেকে দারুণ আর কি হতে পারে!

ভিডিওতে দেখুন আরোরা :