উলিপুরে খামারিদের জন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে প্রণোদনার টাকা বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ কুড়িগ্রামের উলিপুরে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে সরকারের বরাদ্দকৃত প্রণোদনার টাকা বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।পছন্দের লোকজনের তালিকা করে উৎকোচ নিয়ে দেয়া হয়েছে বরাদ্দের টাকা। সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার কারণে একই পরিবারে একাধিক সদস্যকে অর্থ দেয়ার পাশাপাশি ক্রাইটোরিয়া না মানায় অর্থের অপচয় করা হয়েছে। অপরদিকে প্রকৃত অনেক ক্ষতিগ্রস্তরা পায়নি সরকারের এই প্রণোদনা সেবা। ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোয় সরকারের সফল উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে সিন্ডিকেট চক্রের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে। তবে কর্তৃপক্ষ সুবিধাভোগীদের তথ্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলেও লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের চড়েয়ার পাড় গ্রামের বাসিন্দা সোলে বিবি তার পালিত গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছেন। তিনি গরুর খামারের জন্য সরকারের প্রণোদনার ১০হাজার টাকা পেয়েছেন। তার নিজের তিনটি গরু রয়েছে। সোলে বিবি’র পরিবারের ৩সদস্য প্রণোদনার প্রায় ৩০হাজার টাকা পেয়েছেন। তার ছেলে সোলায়মান মুরগির খামার দেখিয়ে ১১হাজার ২৫০টাকা পেলেও খামার রয়েছে সেখানে মুরগি নেই। আরেক ছেলে জাহাঙ্গীরের গরু নেই মায়ের পালিত দেখিয়ে প্রণোদনা ১০হাজার টাকা পেয়েছেন মোবাইলে। এজন্য তাদের প্রণোদনার তালিকায় নাম তুলতে সিন্ডিকেট চক্রকে দিতে হয়েছে উৎকোচের টাকা।
সোলে বিবি জানান,তার নিজেরই গরু রয়েছে তিনটি। ছেলের গরু কয়টি প্রশ্নে তিনি বলেন,বাবা মোর ২টা আর ছেলের একটা গরু আছে। তিনি বলেন প্রণোদনার ১০হাজার টাকা পাইছি। তবে খরচ গেছে চার হাজার টাকা।  সোলে বিবি’র ছেলে জাহাঙ্গীর বাড়িতে কোন গরু দেখাতে পারেনি। তবে টাকা পাবার কথা স্বীকার করেন। গরুর আছে কিনা প্রশ্নে বলেন মোর গরু মার কাছে আদি দিছি। সেখানেই থাকে। প্রণোদনার টাকা পেলেও কাউকে উৎকোচ দেননি বলে জানান।
একই এলাকায় ময়না বেগম বলেন, মুই আর ছেলে বউ দু’জনে ২০হাজার টাকা পাইছি। প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্রের নাম বলতে সাহস না পেলেও জানান,তাদের তালিকায় নাম তুলতে এক হাজার এবং মোবাইলে টাকা আসার পর তিন হাজার টাকা দিছি।  মর্জিনা বেগম বলেন,অফিসের লোক তালিকা করার সময় তিন হাজার টাকা নিয়া তালিকায় নাম দিছে। কিছুদিন আগে গরু পালনের জন্য মোবাইলে ১০হাজার টাকা পেয়েছেন।
বৃদ্ধ শমসের আলী বলেন,বাবা ২টা গরুর জন্য ১০হাজার টাকা পাইছং। এজন্য স্থানীয় দালাল চক্রের সদস্য কাফি ও শাহিনকে তিন হাজার টাকা চাইছে। মুই ওমাক ১শ টাকা দিয়া কইছং চা খাও। আর তিন হাজার টাকা না মুই ওমাক কিছুদিন দুই হাজার টাকা দিবার চায়া সময় নিছং বাহে।
করোনায় গরু,হাঁস,মুরগী খামারী মালিকদের ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য সরকারের প্রণোদনা পেতে শুরু করেছে কুড়িগ্রামের খামারীরা। এই প্রণোদনার টাকা পেতে তালিকায় নাম লেখাতে স্থানীয় দালাল চক্রসহ সংশ্লিষ্টদের ২/৫হাজার টাকা উৎকোচ দিতে হয়েছে সুবিধাভোগিদের। যারা সিন্ডিকেট চক্রের শরাপন্ন হননি তাদের ভাগ্যে জোটেনি সরকারের প্রণোদনার টাকা।
স্থানীয় বাসিন্দা মজিবর রহমান বলেন,উৎকোচের বিনিময়ে সরকারি চাকরিজীবি পরিবারের সদস্যসহ স্বচ্ছল খামারীরা প্রণোদনা পেয়েছেন। আর যারা উৎকোচ দিতে পারেনি তাদের প্রণোদনার তালিকায় নামেই ওঠেনি বলে জানান। সিন্ডিকেট চক্রের সদস্য আব্দুল কাফী উৎকোচ নেবার অভিযোগ অস্বীকার করলেও তার পিতা-আত্নীয়-স্বজনসহ প্রায় ৪০জন প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন বলে জানান। তিনি তালিকা প্রণয়নে কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করেছেন বলে স্বীকার করেন।
কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা থাকায় সুবিধাভোগিদের তথ্য দিতে রাজি হননি উলিপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ আব্দুল আজিজ। উৎকোচ নেবার বিষয়টি অস্বীকার করে সিন্ডিকেট চক্রের নাম জানতে চান। এবং লিখিত অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখবেন বলে জানান তিনি।
এই বিষয়ে উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূর-এ-জান্নাত রুমি বলেন,প্রণোদনা দেয়া শুরু হয়েছে। উপজেলার খামারীদের তালিকা সুপারিশ করেছি। আমার কাছে সুপারিশকৃত তালিকাটি নেই উপজেলা প্রাণিসম্পদের কাছে রয়েছে। উৎকোচ নেবার বিষয়টি আমার জানা নেই। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ আব্দুল হাই সরকার বলেন, উৎকোচ নেবার সুযোগ নেই। আমরা তালিকা করার সময় বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তালিকা করেছি। খামারীদের এনআইডি,মোবাইল নম্বরসহ খামারীর এবং পালিত প্রাণীর ছবি অ্যাপসে আপলোড করা হয়েছে। তবে কেউ যদি অভিযোগ করে সেক্ষেত্রে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান।
জেলা প্রাণি সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়,সরকারের প্রণোদনার জন্য জেলার ৯টি উপজেলার ৩৩হাজার ৫৪৫টি খামারীর তালিকা অ্যাপস-এর মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। ৫টি ক্যাটাগরির মাধ্যমে সুবিধাভোগিরা মোবাইল ব্যাংকিং বা ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে তারা সরকারের এককালিন এই প্রণোদনা পেতে শুরু করেছেন ১৭ফেব্রুয়ারি হতে।
গরুর খামারীরা সর্বনিম্ন ২টি গরুর জন্য ১০হাজার টাকা, ৬-৯টি গরুর জন্য ১৫হাজার টাকা, ১০-২০টি গরুর জন্য ২০হাজার টাকা।
সোনালী মুরগী খামারীরা ১০০-৫০০টি মুরগির জন্য ৪,৫০০টাকা, ৫০১-১০০০টি মুরগির জন্য ৬,৭৫০টাকা, ১০০১টি মুরগির উর্দ্ধে ৯হাজার টাকা।
ব্রয়লার মুরগির খামারীরা ৫০০-১০০০টি মুরগির জন্য ১১,২৫০টাকা, ১০০১-২০০০টি মুরগির জন্য ১৬,৮৭৫টাকা এবং ২০০১টি মুরগির উর্দ্ধে ২২,৫০০টাকা।
লেয়ার মুরগির খামারীরা ২০০-৫০০টি মুরগির জন্য ১১,২৫০টাকা, ৫০১-১০০০ মুরগিতে ১৬,৮৭৫টাকা এবং ১০০১টির উর্দ্ধে ২২,৫০০টাকা।
হাঁস খামারীরা ১০০-৩০০টি হাঁসের জন্য ৩,৩৭৫টাকা,৩০১-৫০০টি হাঁসে ৬,৭৫০টাকা এবং ৫০১টির উর্দ্ধে ১১,২৫০টাকা।