বন্ধু দেশের সাথে তিক্ত সম্পর্কনিইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন

এক সময় দক্ষিণ এশিয়ার দুই বন্ধু প্রতীম দেশ ভারত-বাংলাদেশ এখন তিক্ত সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ভিক্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য নিউয়র্ক টাইমস।

এ দুই দেশে অতীত ও বর্তমান সম্পর্ক নিয়ে প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যমটি দাবি করেছে,

দুই দেশের বর্তমান সম্পর্ক নিয়ে ‘টু সাউথ এশিয়ান নেইবর্স, ওয়ান্স ফ্রেন্ডলি, আর নাউ অ্যাট বিটার ওডস’ শিরোনামের প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।

২৮ নভেম্বর অনলাইন সংস্করণে প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর এর আরেকটি সংস্করণ ভিন্ন শিরোনামে রোববার পত্রিকায় (প্রিন্ট) প্রকাশিত হয়।

প্রতিবেদনটি সম্মিলিতভাবে লিখেছেন ঢাকা থেকে সাইফ হাসনাত ও অনুপ্রীতা দাস আর নয়াদিলি­ থেকে মুজিব মাশাল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক সময়ের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কয়েক মাস ধরে ফুঁসতে থাকা উত্তেজনা সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। বাংলাদেশে একজন হিন্দু পুরোহিতকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতারের পর দুই প্রতিবেশী পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ অভিযোগ তুলেছে।

গত আগস্টে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মিত্র শেখ হাসিনা। তিনি ভারতে পালিয়ে যান। ভারতে তার অব্যাহত উপস্থিতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও মোদি সরকারের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি করেছে।

৮৪ বছর বয়সি নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, হাসিনা ভারতে বসে ক্ষমতায় ফিরে আসার ষড়যন্ত্র করছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতারা ভারতের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও তুলেছেন, রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরছে ভারত।

দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে উত্তেজনার সবশেষ স্ফুলিঙ্গ ছিল চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের ঘটনা। তিনি বাংলাদেশের একজন হিন্দু পুরোহিত। ১৭ কোটি জনসংখ্যার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী ১০ শতাংশের কম।

অতীতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস একটি প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক হিন্দু সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব কৃষ্ণ কনসায়নেস’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এটি ইসকন বা হরে কৃষ্ণ সোসাইটি নামেও পরিচিত।

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের একটি আদালত চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের মামলায় বিচার-পূর্ব কারাগারে পাঠিয়েছেন। এর আগে স্থানীয় একজন রাজনীতিবিদ অভিযোগ (কোতোয়ালি থানায়) দায়ের করেছেন, হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি সমাবেশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করেছেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে নিচে রেখে ওপরে রেখেছিলেন গেরুয়া রঙের পতাকা (হিন্দুধর্মের প্রতীক)।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের সমর্থকরা আদালত ঘেরাও করলে ঘটনা প্রাণঘাতী রূপ নেয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এ সময় একজন মুসলিম আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পর হিন্দুপাড়ায় হামলা ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কারা এই আইনজীবীকে হত্যা করেছেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সহিংসতার অভিযোগে ২০ জনের বেশি ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম নগরীর আইনজীবীরা আদালত বর্জন করেন।

এক বিবৃতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে একজন ধর্মীয় নেতা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে ন্যায্য দাবি পেশ করে আইনি ঝামেলার সম্মুখীন হচ্ছেন। অন্যদিকে হিন্দু দেবতা ও মন্দির অপবিত্র করাসহ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় জড়িত চরমপন্থিরা মুক্ত রয়েছেন।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে মুক্তি না দিলে সীমান্ত অবরোধ করার হুমকি দিয়েছেন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমর্থকরা।

শেখ হাসিনা একটি পুলিশি রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তার সরকার ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় করে কিছু উগ্রবাদীকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল, যারা তার পতনের পর প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু তার শাসনকালেও যথারীতি হিন্দুদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে।

ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকর্তারা সব বাংলাদেশির জন্য সমান সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ‘নয়াদিল্লির পছন্দের নেতা হাসিনার পতন ঘটিয়েছে যে আন্দোলন, তাকে খাটো করতে ভারত বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের দুর্দশাকে একটি আবেগপূর্ণ রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছে।’

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা ভারত থেকে অতিরঞ্জন ও অপতথ্যের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ব্যাপক সহিংসতায় ‘শত শত লোক মারা যাওয়ার’ ঘটনাকে বর্ণনা করতে ভারতের ডানপন্থি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট এবং সরকারের প্রতি অনুগত সংবাদমাধ্যম প্রায়ই গণহত্যার মতো শব্দ ব্যবহার করে। যদিও বাংলাদেশের হিন্দু নেতারা বলেছেন, এই ভুক্তভোগীদের মধ্যে তাদের সম্প্রদায়ের মাত্র কয়েকজন ছিলেন।

গত সপ্তাহে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বাংলাদেশের বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ হিসাবে তিনি শেখ হাসিনাকে ভারতের সুরক্ষা দেওয়া এবং ভারতের ‘অপপ্রচারের’ কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ভারত থেকে ছড়ানো ‘অপপ্রচারে’ সরকারকে চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার কথা বলে অভিহিত করা হচ্ছে।

ড. ইউনূস বলেন, ‘তিনি (হাসিনা) ভারতে আছেন। তিনি অনবরত কথা বলে যাচ্ছেন। এটা পুরো দেশের জন্য কিছুটা অস্থিতিশীল ব্যাপার এবং আমরা ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বলেছি, এটি ন্যায়সঙ্গত নয়। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত কাউকে আপনি জায়গা দিচ্ছেন, আর আপনি তাকে কথা বলতে দিচ্ছেন।’

ড. ইউনূস বলেন, ভারত এমন একটি ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করছে যে তার (ড. ইউনূস) অধীন বাংলাদেশ ‘আফগানিস্তানের মতো’ হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, এটি দেশের নতুন যাত্রার কঠিন কাজকে আরও কঠিন করে তুলছে।

ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করেন, আপনি নিজেকেও অস্থিতিশীল করবেন। কারণ এই অস্থিতিশীলতার উপাদানগুলো আমাদের চারপাশে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে।’

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা ভিন্নমত দমনে যে ঔপনিবেশিক যুগের আইন ব্যবহার করেছিলেন, সেই একই আইনে হিন্দু পুরোহিতকে কারাগারে পাঠিয়ে ড. ইউনূসের সরকার ভালো করেনি।

ভিন্নমতাবলম্বীর সদস্যদের বিরুদ্ধে গণমামলার মতো শেখ হাসিনার কিছু খারাপ কর্মকাণ্ড এখনো অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশের হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা নূর খান লিটন বলেন, ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ ও ‘পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র’-এর মতো শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা আমরা আগেও দেখেছি।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অন্যতম নেতা সারজিস আলম বাংলাদেশে ইসকন নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ইসকনকে একটি ‘চরমপন্থি সংগঠন’ উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এটি আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য ভারতের সঙ্গে জোটবদ্ধ।’

ইসকনের বাংলাদেশের নেতারা বলেছেন, এ সংগঠন আইন মেনে চলে। তারা আদালতের বাইরে মুসলিম আইনজীবীর মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তারা প্রথমে বিবৃতি দিলেও পরে তারা সেটা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছেন।