মহালয়ার যজ্ঞে চেয়ারম্যানসহ দুই হিন্দু নেতার বিরুদ্ধে পানি ঢেলে দেওয়ার অভিযোগ

রাজিব শর্মা, চট্টগ্রাম ব্যুরোঃ পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের সূচনার দিনটিকেই মহালয়া হিসেবে উদযাপন করা হয়। দুর্গাপুজো বাঙালিদের কাছে শ্রেষ্ঠ উৎসব। মহালয়ার দিন থেকেই যেন আরও পুজো পুজো ভাব চলে আসে বাঙালিদের মনে।

আর হিন্দুশাস্ত্রমতে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর মেধস মুনি আশ্রমেই সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা । প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও সেখানে মহালয়ার দিন যজ্ঞের মাধ্যমে সূচনা হয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু এবার দুর্গাপূজার স্মৃতি বিজড়িত সেই তীর্থ মেধস মুনি আশ্রমেই সেই পবিত্র যজ্ঞে পানি ঢেলে দিয়ে ভঙ্গ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠে আনোয়ারা ৭নং সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যানসহ দুই হিন্দু নেতার বিরুদ্ধে।

জানা যায়, আলোচনা সভায় অসুবিধার কারণে অর্ধেক যজ্ঞে পানি ঢেলে দিয়ে বন্ধ করে দেন বলে অভিযোগ এসেছে খোদ হিন্দু নেতাদের বিরুদ্ধেই।

তারা শুধু যজ্ঞ বন্ধ করে ক্রান্ত হননি, তাদেরকে যজ্ঞে পানি ঢালতে বাধা দেওয়ায় সাধু সন্নাসীদের কুরুচিপূর্ণ গালিগালাজসহ মারধরের চেষ্টাও করেন আনোয়ারার সদর ৭নং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসীম কুমার দেব। আর সাধারণ হিন্দুরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারনে শ্যামল পালিত ও অসীম চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেনবিভিন্নজনকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও চাকরিচ্যুত করার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়।

গত বুধবার(৬ অক্টোবর) মহালয়ার যজ্ঞে পানি ঢেলে নষ্ট করার কারনে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে উঠছে নিন্দার ঝড়। সাধারণ হিন্দুরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে । দোষীদের

উক্ত ঘটনায় অপরাধীরা ক্ষমা না চাইলে আন্দোলন ও আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোসহ সনাতনী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, প্রতিবছরই নিয়ম অনুযায়ে মেধসমুনির আশ্রমে মহালয়ার দিন যজ্ঞ ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এবছরও তিথি অনুসারে যজ্ঞ সকাল ৮টা থেকে দুপুর দেড়টায় শেষ হওয়ার কথা ছিলো। আর আলোচনা সভা শুরুর কথা ছিলো দুপুর ১ টায়। কিন্তু সভার প্রধান অতিথি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক যেতে কিছুটা দেরি হওয়ায় আলোচনা সভা দেড়টায় শুরু হয়। তখন যজ্ঞও প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু যজ্ঞ ও আলোচনা সভার স্থান পাশাপাশি একই স্থানে হওয়ায় যজ্ঞের ধোঁয়ায় আলোচনা সভা পরিচালনা করতে সমস্যায় পড়েন হিন্দু নেতারা। তাই সাধুদের যজ্ঞ বন্ধ করার জন্য দুইবার মৌখিকভাবে নির্দেশ দেন পুজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শ্যামল পালিত ও আনোয়ারা ৭নং সদর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান অসীম কুমার দেব । কিন্তু যজ্ঞ শেষ পর্যায়ে থাকায় সন্ন্যাসীরা তাদের কাছে মাত্র ১০ মিনিট সময় চাওয়া হয় শ্যামল ও অসীমদের কাছে। কিন্তু তাতে আলোচনা সভার আলোচকবৃন্দের দেরী হয়ে যাওয়ার ক্ষোভে হিন্দু নেতাদের নির্দেশেই একজন একবালতি পানি নিয়ে যজ্ঞের মাঝখানে ঢেলে যজ্ঞ নষ্ট করে দেয়। যজ্ঞে ব্যবহৃত ধর্মীয় জিনিসপত্র নষ্ট করে ফেলা হয় বলে অভিযোগ উঠে।

এমন কাজের বিরোধীতা করায় সাধুসন্ন্যাসীদের গালাগালি ও মারধরের চেষ্টা করেন সাধারন সম্পাদক অসীম কুমার দেব চেয়ারম্যান। এবং সাধুদের বেশি কথা বললে তুলে নিয়ে আসারও হুমকি দেন তিনি। এমন একটি ভিডিও হাতে এসেছে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিন্দু মহাজোট চট্টগ্রাম জেলার সমন্বয়ক সুমন পাল হুশিয়ারী দিয়ে বলেন, আমাদের কাছে আগে ধর্ম বড়। যজ্ঞের চেয়ে আলোচনা বড় নই। তাদের কাছে ১০ মিনিট সময় চাওয়া হয়েছিল। যজ্ঞে পানি ঢেলে দিয়ে যে কাজ করছে এতে হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত করেছে। এসব আচরণ একজন হিন্দু নেতার মানায় না। শুক্রবারের মধ্যে যদি ওনারা ক্ষমা না চান তবে শনিবার থেকে ওনাদের বিরুদ্ধে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলেও গণমাধ্যমকে তিনি জানান।

তবে সবার সব অভিযোগ ও ভিডিও ফুটেজকে মিথ্যা দাবি করে অভিযুক্ত শ্যামল পালিত বলেন, এরকম কোন ঘটনাই ঘটেনি। তারা এসবে জড়িত নই। এরকম কোন ভুল বুঝাবুঝিরও সৃষ্টি হয়নি। তাদের যজ্ঞ তারা করেছে, আমাদের আলোচনা সভা আমরা করেছি, সুতরাং এখানে যজ্ঞ বন্ধ করার কোন ঘটনা ঘটেনি। এগুলো তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরালকৃক ভিডিও ফুটেজ ও ছবির ব্যাপারে তিনি বলেন এগুলো মিথ্যা, সব মিথ্যা বানোয়াট। শ্যামল পালিতের সুরে সুরে অসীমও জানালেন একই কথা। তিনি বলেন, এরকম কিছু হয়নি। উনি সাধুদের সাথে কোন কথাও বলেননি। তিনি কাউকে মারধর করতে চাননি। কোন সন্নাসীর গায়ে হাত তুলেননি বলে অস্বীকার করেন। তবে যজ্ঞ বন্ধের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, কারা যজ্ঞে পানি ঢেলেছে আমি জানি না। আমাদের কেউ ঢালেনি। তবে সাধুর সাথে অশ্লীল আচরণ করা ভিডিওর মানুষটি যে অসীম চেয়ারম্যান তা নিশ্চিত হওয়া গেছে একাধিক জনের সাথে কথা বলে। তারা সকলেই নিশ্চিত করেছেন যে সাধুদের মারতে যাওয়া ভিডিওর লোকটাই আনোয়ারা উপজেলার ৭নং (সদর) ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান অসীম চেয়ারম্যান। ভিডিওটি বর্তমান এই রিপোর্টারের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।

নিজেদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ বানোয়াট ও মিথ্যা দাবি করলেও তা মানতে নারাজ ক্ষুব্ধ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তারা বলছেন, অভিযুক্তরা নিজেদের দোষ বাঁচাতেই এমনটা বলছে। তারা যদি ক্ষমা না চায় তবে দ্রুতই তাদের বিরুদ্ধে সনাতনী সম্প্রদায় ব্যবস্থা নিবে বলে আল্টিমেটামে জানান একাধিক হিন্দু নেতারা।

এই বিষয়ে বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল করিম জানান, তাদের থেকে একটি অভিযোগ পায়। অভিযোগের ভিত্তিতে আজ (০৯ অক্টোবর) শুক্রবার বোয়ালখালী মেধসমুনি আশ্রমে উভয়পক্ষকে ডাকা হয়েছে। উক্ত বৈঠকে ঘটনার সাথে জড়িতরা মেধসমুনি আশ্রমে সন্নাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে উভয়পক্ষ ঘটনার মীমাংসা করেন বলে নিশ্চিত করেন।

এর আগেও মন্দিরের জায়গা দখলের অভিযোগে তার এলাকা আনোয়ারাতেই মানববন্ধন করা হয় অসীমের বিরুদ্ধে। এ নিয়েও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন রয়েছে।