মাদারীপুর : স্বাধীনতার চার দশক পরও মাদারীপুরের গণহত্যার পাঁচ বধ্যভূমির একটিতেও নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিসৌধ।
এআর হাওলাদার জুটমিল, পাখুল্যা, মিঠাপুর, সেনদিয়া ও কলাগাছিয়া বধ্যভূমি শুধু কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্মৃতির পাতায় লেখা আছে বিষাদময় অনেক কথা। রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত সেই ম্মৃতিই জাতি এঁকে রাখতে চায় সেই স্মৃতিস্তম্ভে, যাতে সকলেই মনে রাখে অতীতের কথা। নিজেদের পূর্বপূরষের গৌরবময় ইতিহাসের কথা।
১৯৭১ সালে সারা বাংলার মানুষ যখন স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল ঠিক তখনই এ দেশের মানুষের টুটি চেপে ধরেছে পাকিস্তানি শাসক চক্র। বাঙালির লাশ পড়েছে রাস্তায় রাস্তায়। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রাণ ভয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় নব্বই লাখ। সাড়ে সাত কোটি মানুষ অধ্যুষিত বাংলার প্রায় এক কোটিই চলে গেছে ওপার বাংলায়। এরপর কি বলে দেওয়ার প্রয়োজন আছে, কতটা নারকীয় গণহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কিভাবে তারা নারীদের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে হাসতে হাসতে।
১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল হানাদার বাহিনী বিমান হামলা চালায় মাদারীপুরে। অনেকটা বিপদমুক্ত ও নিরাপদ বলে মনে করার পর মাদারীপুরে প্রবেশ করে হানাদার বাহিনী, ২৪ এপ্রিল। এরপর মাদারীপুরের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ, নারী নির্যাতন।
শরীয়তপুর ছিল তখন তৎকালীন মাদারীপুর মহকুমার একটি অংশ। বর্তমান শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকার শত শত বাঙালিকে ধরে পাক বাহিনী ও তার দোসররা এআর হাওলাদার জুট মিলে ভেতরে নিয়ে যেত। সেখানকার ডি-টাইপ বিল্ডিংয়ে স্থাপন করা হয়েছিল টর্চার সেল।
সেই সেলে চলতো হাসতে হাসতে মানুষ হত্যা। মেয়েদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের সময় তাদের উল্লাস ধ্বনি শোনা যেতে বহুদূর থেকে। এই জায়গাটি ছাড়াও আডিয়াল খাঁ নদীর তীরে মিলের জেটির ওপর লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় বাঙালি নর-নারীদের । কখনোও বা লাশ ফেলে দেওয়া হতো প্রমত্তা আড়িয়াল খাঁ নদীতে, আবার কাউকে কাউকে গুলি করে হত্যা করা হতো টর্চার সেলের পশ্চিম দিকের খোলা জায়গায়। এরপর মাটি চাপা দেওয়া হতো হতভাগ্যদের। স্বাধীনতার চার দশকেও এসব স্থান চিহ্নিত করে শহীদের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে নির্মাণ করা হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ।
শহর থেকে ৭/৮ কিলোমিটার দূরে মাদারীপুর শ্রীনদী সড়কের পাশে মিঠাপুরের শিকদার বাড়ি বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় শত শত মুক্তিপাগল বাঙালিকে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে ঠিক সেই সময় খান সেনা ও তার দোসরদের হাতে শহীদ হন এ অঞ্চলের শতাধিক বুদ্ধিজীবী ও সুশিক্ষিত মানুষ।
সে সময়কার কথা বলতে গিয়ে ৭০ বছর বয়স্ক নিত্যগোপাল ঠাকুর বললেন, সেই সময় শিকদার বাড়ি ও তার আশপাশের শতাধিক মানুষকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, ‘সে সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলি লাগার পরও প্রাণে বেঁচে যাই কেবল আমি।’ সেই দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘গুলি লাগার পর পর পড়ে যাই আমি। হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা পরে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে ফেলে রেখে যায় আমাকে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই আমি।’
সে দিন নিহত সবাইকে বর্তমান কৃষি ব্যাংক কালিবাজার শাখা ভবন যে স্থানে অবস্থিত সেখানে ও তার আশপাশ এলাকায় মাটি চাপা দেওয়া হয়। কালিবাজার শাখা ভবন নির্মাণের সময় অনেক মানুষের খুলি ও হাড় উদ্ধার করা হয়। বর্তমান কৃষি ব্যাংক কালিরবাজার শাখার পাশে যে বধ্যভূমি রয়েছে, তা চিহ্নিত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানান শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা।
এ ছাড়া রাজৈর উপজেলার পাখুল্লা, সেনদিয়া, কলাগাছিয়া, বধ্যভূমিতে এখনও নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর কবিরের সাথে আলাপকালে জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাখুল্লা সেনদিয়া, কলাগাছিয়া, এআর হাওলাদার জুট মিল, মিঠাপুর বধ্যভূমি ছাড়াও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের কুমার নদীর ফেরিঘাট (বর্তমানে ব্রিজ নির্মিত) এলাকায় অসংখ্য বাঙালি নর-নারীকে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয় কুমার নদীতে।